আজকের দেশ রিপোর্ট ঃ মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের অকুতোভয় আকাশযোদ্ধা গ্রুপ ক্যাপ্টেন (অবঃ) শামসুল আলম, বীরউত্তম গত বৃহস্পতিবার ৮ ডিসেম্বর, আনুমানিক বিকেল ৪ টা ৪৭ মিনিটে এভারকেয়ার হাসপাতাল ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর ৫ মাস। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, ১ পুত্র, ১ কন্যা ও অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। আজ শুক্রবার বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ঘাঁটি বাশার প্যারেড গ্রাউন্ড-এ মরহুমের প্রথম নামাজের জানাযা অনুষ্ঠিত হয় এবং গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। ভারপ্রাপ্ত সেনাবাহিনী প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আতাউল হাকিম সারওয়ার হাসান এবং ভারপ্রাপ্ত বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ এইচ এম ফজলুল হক মরহুমের কফিনে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন। উক্ত জানাযায় সামরিক ও অসামরিক উর্ধ্বতন ব্যক্তিবর্গসহ মরহুমের একমাত্র পুত্র সন্তান হাসিব আলম উপস্থিত ছিলেন। তাঁর দ্বিতীয় নামাজের জানাযা বাদ জুমআ গুলশান আজাদ মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়। জানাযা শেষে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গ্রুপ ক্যাপ্টেন (অবঃ) শামসুল আলম, বীরউত্তম-কে বনানী কবর স্থানে দাফন করা হয়। বীরমুক্তিযোদ্ধার সম্মানার্থে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী কর্তৃক বিভিন্ন বিমানের ফ্লাই পাস্ট অনুষ্ঠিত হয় এবং আকাশ হতে বিমান বাহিনী ঘাঁটি বাশার প্যারেড গ্রাউন্ড ও তার গ্রামের বাড়িতে লিফলেট বিতরণ করা হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনে একটি গৌরবময় অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কিলো ফ্লাইট নামে গঠিত হয় বাংলাদেশ বিমান বাহিনী। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী সৃষ্টির সাথে যে ক’জন বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে মরহুম গ্রুপ ক্যাপ্টেন শামসুল আলম, বীর উত্তম, পিএসসি তাঁদের অন্যতম। কিলো ফ্লাইটের অকুতোভয় এই বৈমানিক মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন।
জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তান ১৯৪৭ সালের ০৯ জুলাই পটুয়াখালী জেলার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। শিক্ষা জীবন শেষে গ্রুপ ক্যাপ্টেন শামসুল আলম ১৯৬৪ সালে পিএএফ একাডেমি, রিসালপুরে যোগ দেন এবং ১৯৬৭ সালে জিডি(পি) শাখায় সাফল্যের সাথে কমিশন লাভ করেন। পরবর্তীতে তিনি যুক্তরাজ্যের রয়্যাল এয়ার ফোর্স স্টাফ কলেজ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ০৩ জুন মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য তিনি এক মাসের ছুটিতে পাকিস্তান থেকে ঢাকায় আসেন। পাকিস্তানিরা ঠিকই উপলব্দি করেছিল যে, তিনি পাকিস্তান বিমান বাহিনী ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিবেন। তাই ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছা মাত্রই পাকিস্তানিরা তাঁকে গ্রেফতার করে। জেলখানাতে পাকিস্তানি উৎপীড়কেরা শামসুল আলমের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত স্বীকারোক্তি আদায়ে কোর্ট মার্শালের অধীনে আনতে চেয়ে সফলকাম হয় নি। পরবর্তীতে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণায় তিনি জেল হতে মুক্ত হন। মাতা-পিতার সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে বাড়ি গিয়ে তিনি মুক্তিসেনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ১৯৭১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ভারতের পথে দেশ ত্যাগ করেন। ১৫ সেপ্টেম্বর তিনি আগরতলায় পৌঁছান এবং তার দু ’দিন পরই কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করেন। সে সময় ডিমাপুরে মুক্তিসেনাদের জন্য সশস্ত্র বিমান বাহিনী গড়ে তোলার প্রস্তুতি চলছিল। পিএএফ-এ পরিবহন বিমানলব্দ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে জনাব শামসুল আলম বিমান বাহিনীর জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তিনি ডিমাপুরে পৌঁছান এবং কিলো ফ্লাইটের পাইলট ও বিমানসেনাদের সঙ্গে মিলিত হন।
কোনরূপ পথ নির্দেশের সুযোগ না থাকা সত্ত্বেও অসীম সাহসী বীর এই মুক্তিযোদ্ধা বৈমানিক ১৯৭১ সালের ৩রা ডিসেম্বর মধ্যরাতে অটার বিমানের বৈমানিক হিসেবে চট্টগ্রামের তেলের ডিপোতে সফল ও দুঃসাহসিক বিমান আক্রমণে অংশগ্রহণ করেন। যার ফলে পাক-বাহিনীর অ্যাভিয়েশন জ্বালানির সরবরাহ ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। পরবর্তীতে তিনি ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত বেশ কয়েকটি সফল অপারেশন পরিচালনা করেন। এই সব অসামান্য সাহসী অভিযান শত্রুপক্ষের খাদ্য, জ্বালানী ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়। এরই ধারাবহিকতায়, শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অবশেষে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় এবং অর্জিত হয় আমাদের কাঙ্ক্ষিত বিজয়। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব ও সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তাঁকে ‛বীর উত্তম ’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য গ্রুপ ক্যাপ্টেন শামসুল আলম, বীর উত্তম-কে ২০১৭ সালে ‛স্বাধীনতা পুরস্কার ’ প্রদান করা হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে গ্রুপ ক্যাপ্টেন শামসুল আলম বাংলাদেশ বিমান বাহিনী গঠন এবং বিমান বাহিনীর প্রথম ট্রান্সপোর্ট স্কোয়াড্রন ও ট্রেনিং একাডেমি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। বিমান বাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় তিনি বিমান সদরের বিমান প্রশিক্ষণ পরিদপ্তরের পরিচালক এবং বিমান বাহিনী ঘাঁটি বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের ঘাঁটি অধিনায়কসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। গ্রুপ ক্যাপ্টেন শামসুল আলম, বীর উত্তম ১৯৮৪ সালের ০২ অক্টোবর বাংলাদেশ বিমান বাহিনী হতে অবসর গ্রহণ করেন। বিমান বাহিনীতে তিনি অত্যন্ত সততা, নিষ্ঠা ও দক্ষতার সাথে তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করেন। বিমান বাহিনী গঠনে অসামান্য অবদানের পাশাপাশি মহান মুক্তিযুদ্ধে গৌরবময় ভূমিকার জন্য গ্রুপ ক্যাপ্টেন শামসুল আলম, বীর উত্তম-কে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রতিটি সদস্য তথা বাঙালি জাতি চিরদিন পরম শ্রদ্ধাভরে ও কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে। তাঁর মৃত্যুতে বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চীফ মার্শাল শেখ আব্দুল হান্নান বিবিপি, বিইউপি, এনএসডব্লিউসি, এফএডব্লিউসি, পিএসসি গভীর শোক প্রকাশ করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।