গ্রেফতারকৃত ডাকাত দলের সদস্যরা
নিজস্ব প্রতিনিধি : মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর থানার ক্লুলেস ডাকাতি মামলার রহস্য উন্মোচন সহ ঘটনার সাথে জড়িত সংঘবদ্ধ ডাকাত দলের সক্রিয় সদস্য মোঃ জাহিদুর রহমান (৪২) এবং বাবু কবিরাজ (৩৫) নামের ২ জন কে গ্রেফতার করেছে পিবিআিই মানিকগঞ্জ জেলা। তাদের দেওয়া তথ্য মতে লুণ্ঠিত মালামাল সহ ডাকাতি কাজে ব্যবহৃত চাকু, টর্চ লাইট উদ্ধার করা হয়।
গত বছরের ৬ মার্চ, রাতে মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর থানাধীন চাকুলিয়া গ্রামে আরিফ মোল্লার বাড়িতে ডাকাতি হয়। গত ৭ মার্চ ২০২২ সালে রাত অনুমান ২ টা ১৫ মিনিটের সময় উত্তর ভিটির চৌচালা টিনের ঘরের দরজা ভাঙ্গার শব্দ পেয়ে আরিফ মোল্লার ঘুম ভাঙ্গে। তিনি এবং তার স্ত্রী তার ঘরের জানালা খুলে দেখতে পায় যে, অজ্ঞাতনামা ৮/১০জন ডাকাত তার বাড়ীতে থাকা ঢেঁকি দিয়ে তার মায়ের ঘরের কাঠের দরজা ভাঙ্গছে। তারা ঘর হতে বের হতে চাইলে অজ্ঞাতনামা একজন ডাকাত তাদেরকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে ঘরে থাকতে বলে।
উক্ত ডাকাতরা তার মায়ের ঘরের ভিতরে গিয়ে তার মা ও ছেলেদের ধারালো অস্ত্র দিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে তার মায়ের গলায় থাকা ৮ আনা ওজনের স্বর্ণের চেইন ও কানে থাকা ৮ আনা ওজনের এক জোড়া কানের স্বর্ণের দুল, তার মায়ের ঘরে থাকা স্টিলের আলমারি ভেঙ্গে আলমারিতে থাকা ৮ আনা ওজনের এক জোড়া স্বর্ণের কানের দুল এবং দুইটি মোবাইল ফোন লুন্ঠন করে নিয়ে যায়।
এই ঘটনায় জনৈক আরিফ মোল্লা মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর থানার মামলা নং ১৩, তাং-০৮/০৩/২০২২ ইং,ধারা-৩৯৫/৩৯৭ পেনাল কোড আইনে মামলা দায়ের করলে থানা পুলিশ মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করেন। থানা পুলিশ মামলাটির তদন্ত করাকালীন পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স এর নির্দেশে পিবিআই মানিকগঞ্জ জেলা মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করে এবং পিবিআই মানিকগঞ্জে কর্মরত পুলিশ পরিদর্শক আশরাফুজ্জামান মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করেন।ইন্সপেক্টর আশরাফুজ্জামানের বদলিজনিত কারণে এসআই (নিঃ) হিরণ চন্দ্র মজুমদার মামলাটির তদন্তভার গ্রহণ করেন।
অ্যাডিশনাল আইজিপি পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার. বিপিএম (বার), পিপিএম এর সঠিক তত্ত্বাবধান ও দিক নির্দেশনায় অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, পিবিআই, মানিকগঞ্জ জেলা এম, কে, এইচ, জাহাঙ্গীর হোসেন পিপিএম এর সার্বিক সহযোগিতায় মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই (নিঃ) হিরণ চন্দ্র মজুমদারের নেতৃত্বে পিবিআই মানিকগঞ্জ জেলার চৌকশ টিম তথ্য প্রযুক্তি ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আসামী মোঃ জাহিদুর রহমান (৪২), পিতা-আফতাব মোল্লা, মাতা-মৃত জাহানারা বেগম, স্থায়ী ঠিকানাঃ সাং-মশাউজান, ইউপি-ডাঙ্গী, থানা-নগরকান্দা, জেলা-ফরিদপুরকে মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর থানাধীন আঙ্গারিয়া গ্রামের শাহিনের ভাড়া বাসা হতে গ্রেফতার করেন।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত আসামী জাহিদুর রহমান জানায় যে, আসামী জাহিদের স্ত্রী গর্ভবতী থাকা কালীণ স্ত্রীর চিকিৎসা জনিত ব্যায় ভার বহণে হিমশিম খাচ্ছিলেন। স্ত্রীর ডেলিভারির সময়ও ঘনিয়ে আসছিল। স্ত্রীর ডেলিভারির খরচ ও অন্যান্য খরচ যোগানোর জন্য আসামী জাহিদ ডাকাতির পরিকল্পনা করে। পর্যায়ক্রমে সে অন্যান্য ডাকাতদেরকে সংগঠিত করে, ডাকাতির প্রস্তুতি গ্রহণ করে এবং ডাকাতি করে।
সেই থেকে শুরু পরবর্তীতে আসামী জাহিদ একটি অটো বাইক কিনে মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর থানা এলাকাসহ ঢাকা জেলার সাভার, কেরানীগঞ্জ এবং নবাবগঞ্জ থানার বিভিন্ন এলাকায় ভাড়া থাকে এবং অটো চালানোর অজুহাতে কোথায় কোথায় ডাকাতি করা যায় তার পরিকল্পনা করে এবং সেই অনুযায়ী ফরিদপুর জেলা থেকে অন্যান্য ডাকাতদের ডেকে এনে ডাকাতি পরিচালনা করে জাহিদ পেশাদার ডাকাতে পরিনত হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত আসামী জাহিদুর ঘটনার সাথে সম্পৃক্ততা স্বীকার করে এবং অপরাধের সাথে জড়িত অন্যান্য আসামীদের নাম ও ঠিকানা উল্লেখ করে।
উক্ত আসামীর দেখানো ও শনাক্ত মতে তার ভাড়া বাড়ি হতে ডাকাতি কাজে ব্যবহৃত চাকু, টর্চ লাইট উদ্ধার করা হয় এবং ডাকাতি মাল (স্মার্ট ফোন) উদ্ধার করা হয়। উক্ত আসামীর দেওয়া তথ্য মোতাবেক ফরিদপুর জেলার বিভিন্ন থানা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে আসামী বাবু কবিরাজ (৩৫), পিতা-নুরু কবিরাজ, মাতা-আলেয়া বেগম, সাং-বিল মামুদপুর (জুলমত মাতুব্বরের ডাঙ্গী), থানা-কোতয়ালী, জেলা-ফরিদপুরকে গ্রেপ্তার করলে তিনিও ঘটনার সাথে সম্পৃক্ততা স্বীকার করে এবং আদালতে ফৌজদারী কার্য বিধির ১৬৪ ধারায় বিবৃতি দেওয়ার ইচ্ছা পোষন করে।
গ্রেফতারকৃত আসামীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে জানা যায় যে, আসামী জাহিদ মোল্লার বাড়ি ফরিদপুর জেলায়। সে দীর্ঘদিন যাবৎ বাড়ির বাইরে থাকলেও ফরিদপুর জেলায় তার পরিচিত অনেক লোকজন রয়েছে। ঘটনার দিন সকালে আসামী জাহিদ তার শ্বশুর বাড়ির পাশে অবস্থিত তার পরিচিত ডাকাত কুরবান বেপারী ও আসামী বাবু কবিরাজকে ফোন ডাকাতি করার প্রস্তাব দেয়। তারা জাহিদের প্রস্তাবে রাজী হয়।
পরবর্তীতে কুরবান বেপারী ও বাবু কবিরাজ মোবাইলে যোগাযোগ করে আসামী জাহিদ মোল্লার কথা মোতাবেক ঐদিন মৈনট ঘাটে যায়। সেখানে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করে। সন্ধ্যার দিকে জাহিদ কুরবানকে ফোন দিয়ে বান্দুরা বাজারে যেতে বলে। বাবু ও কুরবান সেখানে গিয়ে জাহিদ, জাহিদের ভায়রা বাদশা, জাহিদের শ্যালক রেজাউল, রাকিব ও ছোট বাবুকে দেখতে পায়। পরে সবাই একত্রিত হয়।
বাদশা ও জাহিদের নেতৃত্বে তারা সবাই জামশা বাজারে যায়। রাত অনুমান ০৮.০০ ঘটিকায় জামশা বাজারে একটি হোটেলে খাওয়া দাওয়া করে। এর আগে জামশা বাজারে যাওয়ার পথে একটি ফাঁকা ভিটায় কিছু সময় কাটায়। আগেই সেই ভিটাতে চাকু এবং বিভিন্ন বাড়ি থেকে বটি ও দাঁ সংগ্রহ করে লুকিয়ে রেখেছিল। তাদের কেউ লুঙ্গি পড়া অবস্থায় এবং কেউ প্যান্ট পড়া অবস্থায় ছিল। রাত ১২ টার দিকে জাহিদ ও বাদশা ঘটঁনাস্থলের বাড়িতে নিয়ে যায়।
মুলত বাড়ির পাশের রাস্তায় বাকি সদস্যদের দাঁড় করে রেখে বাদশা ও জাহিদ বাড়ি দেখতে যায়। তখন প্রায় রাত ১ টায় বাদশা ও জাহিদ দরজার পাশের গ্রিল ভেঙ্গে বারান্দায় প্রবেশ করে এবং বারান্দার দরজা খুলে দেয়। পরে পাশের বাড়ি থেকে সিমেন্টের খুটি নিয়ে এসে চার জন মিলে সিমেন্টের খুটি দিয়ে দরজায় ধাক্কা দেয়।
ফলে দরজা ভেঙ্গে যায়। বাদশা, জাহিদ, বাবু ও রাকিব মিলে ধাক্কা দেয়। সকলেই মুখোশ পড়া ছিল। আসামী জাহিদ ঘরের ভিতর ঢুকে। ঘরে থাকা মহিলাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয়। পরে বাদশা, রাকিব, রেজাউল ও বাবু ভিতরে প্রবেশ করে। কুরবান রাস্তায় পাহাড়ারত ছিল। ছোট বাবু দরজার সম্মুখে দাঁড়ানো ছিল। জাহিদ ,বাদশা ,রাকিব ও বাবু মিলে ঘরে রক্ষিত টাকা, মোবাইল ফোন, স্বর্ণালংকার ও কিছু কাপড় চোপরসহ অন্যান্য কিছু জিনিসপত্র নিয়ে ডাকাতরা চলে যায়। ডাকাতির এক দিন পরে আসামী জাহিদ আসামী কুরবানকে ডাকাতির টাকা প্রেরণ করে। প্রেরিত টাকা থেকে পরবর্তীতে কুরবান বাবুকে ২০,০০০ টাকা দেওয়া দেয়।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, এম, কে, এইচ, জাহাঙ্গীর হোসেন, পিপিএম, পিবিআই, মানিকগঞ্জ জেলা জানান, অত্র মামলার ডাকাত দলের সদস্যরা অনেক দুর্ধূর্ষ প্রকৃতির ও পেশাদার ডাকাত। ডাকাত দলের সদস্যদের বাড়ি মূলত ফরিদপুর জেলার বিভিন্ন থানা এলাকায়। ডাকাত জাহিদসহ তার ভায়রা ও শ্যালকেরা মাকিনগঞ্জ জেলার সিংগাইর, ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ, নবাবগঞ্জ ও সাভার এলাকার বিভিন্ন বাড়ি টার্গেট করে ডাকাতি করে। ডাকাত দলের সর্দার জাহিদ হ্যালোবাইক চালানোর নাম করে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে এবং কোন কোন বাড়িতে ডাকাতি করা যায় সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা মোতাবেক তার আত্মীয় ও পরিচিত ডাকাতদের ডেকে এনে ডাকাতি করে।
অত্র মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই(নিঃ) হিরন চন্দ্র মজুমদার জানায় যে, অত্র মামলার ডাকাত দলের সদস্যরা অত্যন্ত চতুর। তারা তাদের নিজেদের নামে কোন মোবাইল ও সিম ব্যবহার করে না। ডাকাত জাহিদ দীর্ঘদিন যাবত মানিকগঞ্জ ভাড়া বাসায় বসবাস করলেও মানিকগঞ্জ এর কোন লোকের সাথে মোবাইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করে না। সে যে বাড়িতে ভাড়া থাকে সেই বাড়ির মালিককে তার কোন ভোটার আইডি কার্ড দেয় না। কোন বাড়ির মালিক যদি ভোটার আইডি কর্ডের জন্য চাপ দেয় তাহলে সে উক্ত বাসা ছেড়ে অন্য জায়গায় ভাড়া নেয়। দীর্ঘদিন প্রচেষ্টার পর গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পিবিআই মানিকগঞ্জ জেলার একটি চৌকোস টিমের সহায়তায় অত্র মামলার ডাকাত সর্দার জাহিদকে গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীতে তার দেওয়া তথ্য মোতাবেক অন্যান্য ডাকাতদের শনাক্ত ও গ্রেফতার করা হয়। জাহিদের দেওয়া তথ্য মোতাবেক ডাকাতি কাজে ব্যবহৃত টর্চ লাইট, চাকু তার ভাড়া বাড়ি হতে উদ্ধার পূর্বক জব্দ করা হয়। বাদীর বাড়ি হতে ডাকাতি হওয়া মোবাইল ফোনটিও তার দেওয়া তথ্য মোতাবেক উদ্ধার করা হয়।