চট্টগ্রাম বন্দরের কী কী ঘাটতি মেটাবে মাতারবাড়ি?

Uncategorized অন্যান্য

অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ঃ এশিয়ার গভীরতম সমুদ্রবন্দরের একটি মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দর এর প্রকল্প একনেকে পাশ করা হয়েছে। এই চ্যানেলের গভীরতা ১৬ মিটার যেটা স্বাভাবিক ভাবেই সিঙ্গাপুর, কলম্বো বা অন্যান্য গভীর সমুদ্র বন্দর থেকে বেশি। আর এই বন্দরকেই ড্রেজিং করে ১৮.৫ মিটার করা হবে।
প্রশ্ন হল এতে করে আসলে বাংলাদেশ কি সুবিধা পাবে???
ভিয়েতনামের সাথে বাংলাদেশ পেরে উঠছে না যেসব কারনে তার অন্যতম হল ভিয়েতনামের মত কম সময়ে আমরা পণ্য ক্রেতার কাছে পৌছাতে পারিনা। আর সময় এর অপর নাম অর্থ। ব্যাবসার ক্ষেত্রে যত দ্রুত কোন একটা ডিল শেষ করে পণ্য পৌছান যায় তত বেশি টার্নওভারের সুযোগ থাকে। ক্যাপাসিটির পূর্ন ব্যাবহার সম্ভব হয়। বাংলাদেশের দূর্বল অবকাঠামো এমনিতেই লিড টাইম কমানোর ক্ষেত্রে বড় বাধা। আর সব থেকে বড় বাধা হল চট্টগ্রাম বন্দর। এখানে পণ্য খালাস এবং লোডিং এ প্রচুর সময় নষ্ট হয়। যদি আমরা আক্ষরিক অর্থেই বাংলাদেশ আর ভিয়েতনাম কে দুটি মানুষ হিসাবে চিন্তা করি যারা কোন দৌড় প্রতিযোগিতা করছে তাহলে বুঝতে পারবেন যে যে যত দ্রুত দৌড়াতে সক্ষম, যত কম সময়ে কাজ করতে সক্ষম যে জয়ী। এভাবে উদাহরন দেয়া শুধু মাত্র আপনাদের বুঝানোর স্বার্থে। দ্বিতীয় যেই সমস্যা আমাদের দেশে সেটা হল খরচ। পরিবহন খরচে কিভাবে অবকাঠামো ভূমিকা রাখে সেটি পদ্মা সেতু নিয়ে পোস্টেই ব্যাখ্যা করেছি। যত বেশি সময় লাগবে খরচ তত বাড়বে। আরেকটা বড় দিক হল মোড অব ট্রান্সপোর্টেশন। কোন পণ্য গন্তব্যে পৌছতে যত বেশি মোড চেঞ্জ করা হবে তত খরচ এবং সময় বেশি লাগবে।

আজকের লেখা শুধু বন্দর কেন্দ্রীক দিক গুলিই তুলে ধরছি। এবার আসা যাক চট্টগ্রাম বন্দর এর সমস্যা কোথায় এবং মাতারবাড়ি কোথায় আমাদের জন্য সুযোগ?
চট্টগ্রাম বন্দরে সর্বোচ্চ ১৯০ মিটার দৈর্ঘের জাহাজ এবং ৯ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারে। স্বাভাবিক ভাবেই বুঝতে পারছেন এখানে কোন মাদার ভেসেল ভেড়ার সুযোগ নেই। এর জন্য আমাদের কি করতে হয়?
প্রথমে মাদার ভেসেল কে বহির্নোঙর এ অপেক্ষা করতে হয়। বন্দর থেকে ছোট সাইজের ফিডার ভেসেল রওনা করে মাদার ভেসেলের কাছে পৌছায়। এরপর মাদার ভেসেল থেকে পণ্য ফিডার ভেসেলে আনলোড করতে হয়। এরপর সেই ফিডার ভেসেল আবার বন্দরে এসে সেটা আনলোড করে।
রপ্তানির ক্ষেত্রে এমন হয় যে আমরা সরাসরি মাদার ভেসেলে পণ্য উঠাতে পারিনা বলে সিঙ্গাপুর বন্দরে মাদার ভেসেল বুকিং দেই। এরপর সেখানে যেয়ে আমাদের পণ্য মাদার ভেসেলে উঠে। আর এখানেই আমাদের সময় বেশি লাগতেছে, মোড অব ট্রান্সপোর্টেশন বেশি লাগতেছে, ইকোনমাইজ অব স্কেল অর্জন করতে ব্যার্থ হচ্ছে বাংলাদেশ। চিন্তা করে দেখুন চট্টগ্রাম বন্দরে সর্বোচ্চ ২০০০ টিইউএস বাহী জাহাজ ভীড়তে পারে। কিন্তু মাতারবাড়ির ড্রাফট বেশি হবার কারনে এখনে ৮০০০ টিইউএস নিয়ে জাহাজ ভিড়তে পারবে। চট্টগ্রাম বন্দরে সাধারণত ৬-৭ টা জাহাজ লাগে ৪০০০ কন্টেনার ক্যারি করতে লাগে। চট্টগ্রাম বন্দর প্রতিদিন ৩৫০০ থেকে ৪০০০ কন্টেইনার হ্যান্ডেল করতে পারে। কিন্তু মাতারবাড়িতে এক জাহাজেই ৮০০০ কন্টেইনার হ্যান্ডেল করলে খরচ কমবে, সময় বাচবে। দৌড়ে এগিয়ে থাকা যাবে। বর্তমানে ভিয়েতনামের লিড টাইম হিসাব করলে আমরা প্রতিযোগিতা করতেও সক্ষম নই। কিন্তু তখন সেই স্থানটি পূর্ন হবে। ২০২৬ সালে জাপানের সহায়তায় এই বন্দরের কাজ শেষ হবে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এ প্রকল্পে জাইকা ঋণ বাবদ দেবে ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। বাংলাদেশ সরকারের তহবিল থেকে আসবে ২ হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ টাকা এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ অর্থায়ন করবে ২ হাজার ২১৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ‘দ্য বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট (দি বিগ-বি)’ শীর্ষক উদ্যোগের আওতায় সমুদ্রবন্দরটি নির্মিত হচ্ছে। জাপানের কাশিমা ও নিগাতা (পূর্ব) নামের দুটি বন্দরের আদলে গড়ে তোলা হবে দেশের প্রথম এ গভীর সমুদ্রবন্দর। এতে থাকবে একটি কনটেইনার টার্মিনাল ও একটি মাল্টিপারপাস টার্মিনাল। এই টার্মিনালের দৈর্ঘ ৩০০ ও ৪৬০ মিটার। এ প্রকল্পে অন্যান্য কাজের সঙ্গে প্রায় ২৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের চার লেনবিশিষ্ট সড়ক এবং ১৭টি সেতু নির্মাণ করা হবে। আর এ ১৭টি সেতুর দৈর্ঘ্য প্রায় সাত কিলোমিটার। ২০২৬ সালে একটি মাল্টিপারপাস জেটি ও একটি কনটেইনার জেটি চালুর মধ্য দিয়ে এ গভীর সমুদ্রবন্দরের পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম শুরু হবে।
সড়কপথে পণ্য পরিবহনে সড়ক ও জনপথ বিভাগ চকরিয়া হয়ে মাতারবাড়ী পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণ করবে এবং এ সড়ক যুক্ত হবে এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে। এছাড়া রেলপথ বিভাগের চট্টগ্রামের দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুনধুম পর্যন্ত প্রস্তাবিত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প মাতারবাড়ী বন্দরের সঙ্গে যুক্ত হবে। রেল সংযোগের কাজ চালু হলেও রোহিঙ্গা সংকটের কারণে আপাতত কাজ বন্ধ রয়েছে।এই প্রকল্পে আরো যেগুলি করা হচ্ছে সেগুলা যথাক্রমে, দুইটা কি গ্যান্ট্রি ক্রেন, একটি মাল্টি গ্যান্ট্রি ক্রেন, ৬ টা রাবার টায়ারড গ্যান্ট্রি ক্রেন, দুইটু রিচ স্ট্যাকার ট্রাক্টর চেসিস, ২৭ কিলোমিটার চার লেনের সড়ক, তিনটি টাগবোট একটি পাইলট বোট, একটি সার্ভে বোট

বর্তমানে বছরে ৩০ লাখ টিইইউ (টোয়েন্টি-ফুট ইকুইভেলেন্ট ইউনিট) কনটেইনার হ্যান্ডেল হচ্ছে। ২০৪০ সালের মধ্যে ১ কোটি ২৫ লাখ টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করতে হবে। আর সেক্ষেত্রে সব থেকে গুরুতপূর্ন ভূমিকা রাখবে এই বন্দর।
মাতারবাড়ি ইকোনমিক জোন, এবং বিদ্যুৎ হাবের জন্য এমনিতেই এখানে একটি পোর্ট করা লাগত। চীনের ফাঁদে পড়ে সোনাদিয়া বন্দর না করে এখনে এই সাপোর্ট বন্দরকে পূর্নাঙ্গ গভীর সমুদ্রবন্দর করায় অর্থেক অনেক বড় অপচয় থেকে আমরা বেচে গেছি। আর চীনের BRI এর অধীনে বন্দর না করে জাপানের BIG-B এর অধিনে বন্দর করার ফলে বাংলাদেশের ভবিষ্যত অবকাঠামোর বড় একটা সাপোর্ট হবে সেটা বলাই বাহুল্য।


বিজ্ঞাপন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *