সুমন হোসেন, (যশোর) : যশোর সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে একেবারে শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। এটির মাধ্যমে এক প্রকার ইতিহাস তৈরি হলো। ভোট হবে আর কোনো রকম অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটবে না এটি কল্পনা করা যায় না! সেটিই হয়েছে এবার যশোরে। একেবারেই নিরুত্তাপ ভোটে সদর উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন তৌহিদ চাকলাদার ফন্টু। তিনি পেয়েছেন ৫৭ হাজার ৯১৪ ভোট। যদিও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছিল কঠোর অবস্থানে। তাদের বার্তা ছিল,‘এদিক-ওদিক’ করলে ছাড় নেই। জড়িতদের বিরুদ্ধে নেওয়া হবে কঠোর ব্যবস্থা। কোনোরকম ঝামেলা করলে পুলিশ যাতে সাথে সাথে অ্যাকশনে যায় সেই নির্দেশনাও ছিল। এ কারণে প্রার্থীর সমর্থকরা অবস্থা বেগতকি হবে আঁচ করতে পেরে ‘শান্ত’ ছিল। ফলে, ভোটের আট ঘণ্টা নিরুত্তাপ পরিবেশ বিরাজ করে।
এদিকে, যিনি বিজয়ী হয়েছেন তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ফাতেমা আনোয়ার পেয়েছেন ৫৫ হাজার ৬১০ ভোট। সরেজমিনে বিভিন্ন কেন্দ্র পরিদর্শন করে ভোটার উপস্থিতি কম থাকার চিত্র চোখে পড়ে। তবে, শহরের তুলনায় গ্রামের কেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতি বেশি ছিল।
সকাল আটটা থেকে বিরতিহীনভাবে বিকেল চারটা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। যা, যশোরের জন্য রেকর্ড। নির্বাচনে চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ১৬ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এরমধ্যে চেয়ারম্যান পদে আট, ভাইস চেয়ারম্যান পদে পাঁচ ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে তিনজন প্রার্থী ছিলেন। চেয়ারম্যান পদে আনোয়ার হোসেন বিপুল দোয়াত-কলম প্রতীকে ৩৬ হাজার ৬১১, শফিকুল ইসলাম জুয়েল কাপ পিরিচ প্রতীকে ১৪ হাজার ১৫৯, মোস্তফা ফরিদ আহমেদ চৌধুরী আনারস প্রতীকে ১২ হাজার ৫৪৬, মোহিত কুমার নাথ শালিক প্রতীকে ৯ হাজার ৯০৪, শাহারুল ইসলাম জোড়া ফুল প্রতীকে ৮ হাজার ৫০৬ ও আ.ন.ম আরিুফুল ইসলাম হীরা হেলিকপ্টার প্রতীকে ৬ হাজার ২১৯ ভোট পেয়েছেন।
ভাইস চেয়ারম্যান পদে সুলতান মাহমুদ বিপুল টিউবওয়েল প্রতীকে ৮৩ হাজার ২১৯ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কামাল খান পর্বত তালা প্রতীকে পেয়েছেন ৪৫ হাজার ২৫৩ ভোট, শেখ জাহিদুর রহমান বৈদ্যুতিক বাল্ব প্রতীকে ৩৭ হাজার ৬৭৫, শাহজাহান কবীর শিপলু চশমা প্রতীকে ২৪ হাজার ৫৭৪ ও মনিরুজ্জামান উড়োজাহাজ প্রতীকে ৯ হাজার ৯৫২ ভোট পেয়েছেন।
মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে বাশিনুর নাহার ঝুমুর ফুটবল প্রতীকে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫২১ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জ্যোৎস্না আরা মিলি কলস প্রতীকে ৫৫ হাজার ১৫ ভোট পেয়েছেন। অপর প্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পী খাতুন হাঁস প্রতীকে পেয়েছেন ৩২ হাজার ১৫৮ ভোট।
অনেক কেন্দ্রে ইভিএমের কারিগরি ত্রুটি ধরা পড়ে। এ কারণে অনেকেই সময়মতো ভোট দিতে পারেননি। এমনই একটি কেন্দ্র পৌরসভার সেবাসংঘ পুরুষ কেন্দ্র। বেলা ১১ টা ৪০ মিনিটে এই কেন্দ্রে ভোট দিতে আসেন যশোর-৩ (সদর) আসনের এমপি কাজী নাবিল আহমেদ। তিনি ভোট দেয়ার সময় ইভিএমে সাড়া দিচ্ছিল না। বেশ কিছু সময় চেষ্টা করে সহকারী প্রিজাইডিং ও পোলিং অফিসাররা ব্যর্থ হন। এরপর প্রিজাইডিং অফিসার এনআইডি নম্বর ব্যবহার করে এমপি কাজী নাবিল আহমেদকে ভোট দেয়ার ব্যবস্থা করে দেন। এ বিষয়ে ওই কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মুজিবুর রহমান বলেন,‘প্রথমে ইভিএমে এমপি সাহেব ভোট দিতে পারেননি। তার ফিঙ্গার প্রিন্ট আসছিল না। এরপর এনআইডি দিয়ে ভোট দেয়ার ব্যবস্থা করি।’
এদিকে, অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট গ্রহণ করতে সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। শান্তিপূর্ণ ভোট গ্রহণ করতে মোতায়েন করা হয় ২ হাজার ১০০ পুলিশ। আনসার ছিল ৩ হাজার ৩৫০। সেই সাথে ছিল চার প্লাটুন বিজিবি, র্যাবের চারটি টিম, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট একজন এবং ১৮ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। ইভিএমে ভোট গ্রহণ করেন ৫ হাজার ৪৮৭ কর্র্মকর্তা। এরমধ্যে ২১৯ জন প্রিজাইডিং, ১ হাজার ৭৫৬ জন সহকারী প্রিজাইডিং ও ৩ হাজার ৫১২ পোলিং অফিসার ছিলেন। এবার ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের খুব ভালোভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় বলে জানান কয়েকজন প্রিজাইডিং অফিসার।
শতদল পৌর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রিজাইডিং অফিসার অনিমেষ বিশ্বাস বলেন,‘মানুষ এখন অনেক সচেতন। এ কারণে ইভিএমে ভোটগ্রহণ করতে তেমন কোনো সমস্যা হয়নি।’ এই কেন্দ্রে একজন ভোটার হাতে মেহেদি দিয়ে আসায় তার ফিঙ্গার প্রিন্ট আসেনি। এ কারণে সাবান দিয়ে ভালো করে ধুয়ে আসার পরামর্শ দেয়া হয় তাকে।
আব্দুর রাজ্জাক কলেজ কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি ছিল একেবারেই কম। এ কারণে অনেক সহকারী প্রিজাইডিং, পোলিং অফিসারসহ অন্যান্যদের অলস সময় পার করতে দেখা যায়। ব্যতিক্রম ছিল সেবাসংঘ কেন্দ্র। এই কেন্দ্রের বাইরে অনেক ভিড় ছিল। ভোটারের সংখ্যাও ছিল তুলনামূলক বেশি। এই কেন্দ্রের আশপাশে চারজন প্রার্থীর বাড়ি হওয়ায় তারা তাদের মতো করে ভোটার আনেন কেন্দ্রে।
রিটার্নিং অফিসার আব্দুর রশিদ জানান, চমৎকার পরিবেশে ভোটাররা ভোট প্রয়োগ করেছেন। তিনি বলেন, উপজেলার একটি পৌরসভা ও ১৫টি ইউনিয়নের ২১৯টি কেন্দ্রে ইভিএমে ভোটগ্রহণ করা হয়। মোট ভোটার ছিল ৬ লাখ ৭ হাজার ৭৪২। এরমধ্যে পুরুষ ৩ লাখ ৪ হাজার ৭৩০, মহিলা ৩ লাখ ৩ হাজার ৫২ ও তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ছিল ৭ জন। ২১৯ কেন্দ্রের ১ হাজার ৭৫৬ টি কক্ষে ভোটগ্রহণ হয়। মোট ২ লাখ ২ হাজার ২০৩ জন ভোটার ভোট প্রয়োগ করেন। এরমধ্যে চেয়ারম্যান পদে ৭৩৪, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ১ হাজার ৫৩০ ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ১ হাজার ৫০৯ ভোট বাতিল হয়েছে। প্রাপ্ত ভোটের শতকরা হার ৩৩.২৭ বলে জানিয়েছেন রিটার্নিং অফিসার আব্দুর রশিদ।
উল্লেখ্য, ২৯ মে যশোর সদর উপজেলার নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ ছিল। একটি মামলার কারণে পিছিয়ে ৫ জুন তারিখ নির্ধারণ করে কমিশন।