চাঁদাবাজ গমচোরদের জন্য আলাদা পল্লী 

Uncategorized উপ-সম্পাদকীয়/মতামত রাজনীতি

গোলাম মওলা রনি, সাবেক সংসদ সদস্য।

গোলাম মওলা রনি : প্রথমে ইচ্ছে ছিল আজকের নিবন্ধটি শুরু করব বিখ্যাত হিন্দি সিনেমা ওমরাও জানের কাহিনী দিয়ে। ১৯৮১ সালে নির্মিত সিনেমাটিকে ধরা হয় ভারতীয় চলচ্চিত্রের সর্বকালের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে। ১৯০৫ সালের সাড়া জাগানো উর্দু উপন্যাস ওমরাও জান আদা অবলম্বনে যখন চলচ্চিত্রটি নির্মিত হচ্ছিল তখন অনেক নামকরা সাহিত্যিক সমালোচনা করে বলেছিলেন, মির্জা হাদির মতো লেখকের কাহিনীকে চলচ্চিত্রে বাস্তব রূপ দেয়ার সাধ্য ভারতবর্ষের কোনো চিত্রপরিচালকের নেই। কিন্তু পরিচালক মোজাফফর আলী অভিনেত্রী রেখা এবং ফারুখ শেখ, রাজ বাব্বর ও নাসির উদ্দিন শাহের মতো অভিনেতাদের দিয়ে সেলুলয়েডের পর্দায় অমর কথাশিল্পী মির্জা হাদির কাহিনীকে এমনভাবে জীবন্ত করে তুললেন যার তুলনা কেবল ভারতবর্ষে নয়- তামাম দুনিয়াতেই বিরল।

ওমরাও জানের কাহিনী নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে গিয়ে মনে হলো, আজকের শিরোনামের যথার্থতা যদি কোনো বিখ্যাত চলচ্চিত্রের কাহিনীর আদলে বর্ণনা করতে চাই সে ক্ষেত্রে এর চেয়েও প্রাসঙ্গিক হবে অন্য একটি চলচ্চিত্রের কাহিনী। সিনেমাটির নাম ‘মান্ডি’। ‘বলিউডের বাদশাহ’ খ্যাত মেগাস্টার শাহরুখ খানের প্রযোজনা সংস্থার মালিকানাধীন সিনেমা মান্ডি নির্মিত হয়েছিল ১৯৮৩ সালে। এই সিনেমার কাহিনীও একটি জনপ্রিয় উর্দু ছোটগল্প থেকে নেয়া হয়েছে। গোলাম আব্বাস লিখিত ছোটগল্প আনন্দি অবলম্বনে পরিচালক শ্যাম বেনেগাল মান্ডি সিনেমা নির্মাণ করে সারা ভারতে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। শাবানা আজমি, নাসির উদ্দিন শাহ এবং স্মিতা পাতিলের অনবদ্য অভিনয়ে রাজনীতি এবং পতিতাবৃত্তির যে রসায়ন দেখানো হয়েছে তা অন্য কোনো ভারতীয় চলচ্চিত্রে দেখা যায় না।

রাজনীতির সঙ্গে দুর্নীতি এবং দুর্নীতির সঙ্গে ঘুষ যেভাবে একটি বৃত্ত বা বলয় তৈরি করে, ঠিক সেইভাবে মদ-যৌনতা এবং জুয়া আলাদা একটি নিউক্লিয়াস পয়দা করে- দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবিদ এবং তাদের বশংবদ আমলা কামলার অবৈধ অর্থের তৈরি করা দেয়ালটিকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে রাখে। এক্ষেত্রে সাধারণ সমীকরণ হলো- মদ-যৌনতা এবং জুয়ার সমন্বয়ে গঠিত নিউক্লিয়াসটি বৈজ্ঞানিকভাবে সচল না থাকলে ঘুষ-দুর্নীতির দেয়াল তৈরি হয় না অথবা তৈরি হলেও তা ভেঙে যায়। আমাদের দেশের অর্থনীতির কালো টাকা এবং রাজনীতি-আমলাতন্ত্র ও বুদ্ধিবৃত্তির কালো প্রাণীগুলো কেন সুইস ব্যাংকে টাকা জমা রাখে, কানাডায় বেগমপাড়া বানায় এবং সিঙ্গাপুর আর ম্যাকাও ব্যাংকের ইন্ডিয়ানার জুয়ার কোর্টগুলোতে গিয়ে দেউলিয়া হয়ে কিভাবে এ দেশের ব্যাংক-বীমা শেয়ার মার্কেট লুট করে তা হৃদয়ঙ্গম করার জন্য সম্মানিত পাঠক ইচ্ছে করলে মান্ডি চলচ্চিত্রটি দেখে নিতে পারেন।

আজকের নিবন্ধে আমি ওমরা ও জান অথবা মান্ডি নিয়ে আর বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে ২০২০ সালের বাংলাদেশের দুর্নীতি-চাঁদাবাজি-চুরি-চামারির হোতা যাদের গ্রামবাংলার মানুষ সাধারণত গমচোর, চালচোর, ত্রাণচোর ইত্যাদি বলে সম্বোধন করেন তাদের বেপরোয়া কুকর্ম এবং নিয়ন্ত্রণহীন পাপাচার কিভাবে দেশ জাতি এবং সমাজ-সংসারকে রসাতলে নিয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে আলোচনার চেষ্টা চালাব। আমাদের দেশে ক্যাসিনো কেলেঙ্কারি অথবা পাপিয়া কাহিনী যখন সগৌরবে চলছিল, তখন গমচোরেরা অনেকটা নিশ্চিন্তে ছিলেন। তাদের মধ্যে যারা পাপের অর্থে বাহারি পাপকর্মের জন্য হরহামেশা বিদেশে যেতেন তারা নিজ দেশের আনাচে কানাচে মদ-নারী-জুয়ার জন্য ছোটবড় অসংখ্য হেরেম বানিয়ে নিজের বিত্ত ও বৈভব দ্বারা শক্ত প্রাচীর নির্মাণ করে চলছিলেন। ফলে করোনা-পূর্ব বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থায় দুর্নীতির অর্থের দেয়াল এবং মদ-যৌনতা-জুয়ার আড্ডার মধ্যে একটি সেতুবন্ধন তৈরি হয়ে গিয়েছিল।

বাংলাদেশের উল্লিখিত সেতুবন্ধনটি করোনার কবলে পড়ে অনেকটা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছে। কোনো গবেষণাগারে রক্ষিত জীবাণু যদি মনুষ্য সমাজ ছড়িয়ে পড়ে, অথবা কোনো জায়গায় যদি পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটে তবে জীবাণু এবং পরমাণু শক্তির দানবীয় রূপ যেমন মানব সভ্যতাকে বিলীন করে দেয় তদ্রূপ আমাদের দেশের বেপরোয়া ঘুষ-দুর্নীতি, চাঁদাবাজি-দখল ইত্যাদি কুকর্ম এবং এতদসংক্রান্ত ভোগ-বিলাস বাণিজ্যের ঘাটতি-সরবরাহ ও জোগানের পার্থক্য এবং সংরক্ষণের সমন্বয়ের অভাবে অনেকের শরীর ও মনে পচন ধরেছে। কেউ কেউ আবার আহত জানোয়ারের মতো হিংস্র হয়ে পড়েছে। এ শ্রেণীর আরেকটি অংশ ক্ষুধার্ত হায়েনার বেশে লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে এবং জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে।

আপনি যদি গত তিন মাসের অপরাধের খতিয়ান বিবেচনা করেন তবে দেখবেন যে, হাজার কোটি টাকা লোপাটকারী গমচোর দুর্নীতিবাজ ও চাঁদাবাজরা সামান্য কয়েক হাজার টাকার জন্য নিরীহ মানুষজনের ওপর হামলে পড়েছে। ঘুষখোরেরা ঘুষের টাকা না পেয়ে খাওয়া-দাওয়া-নিদ্রা ছেড়ে দিয়েছে। কারণ ঘুষ তাদের প্রাত্যহিক জীবনে এতটাই প্রভাব বিস্তার করেছে যে, রোজ যদি নির্দিষ্ট অঙ্কের ঘুষ তারা হাতে না পায় তবে তাদের মনোজগতে এক ধরনের বিষক্রিয়া সৃষ্টি হয়। তাদের মধ্যে হীনম্মন্যতা দেখা দেয়। তারা মনে করে যে, লোকজন সম্ভবত তাদের গুরুত্ব দিচ্ছে না। অন্য দিকে, ঘুষের টাকা ব্যাগভর্তি করে তারা প্রতিদিন যেভাবে বীরদর্পে ঘরে ফেরে এবং স্ত্রীর কাছে সেই অবৈধ পোঁটলা জমা রেখে নিজের হারামখোর পেট ও পোঁটলা নিয়ে যেভাবে রাতের আঁধারে অনৈতিক ইন্দ্রিয় সুখের জন্য বের হয়ে যায় এবং নিজের ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীকে অবাধে সব অপকর্ম করার স্বাধীনতা দেয় তা সাম্প্রতিককালে এসে সব এলোমেলো হয়ে পড়েছে।

হারামখোরদের যে অংশটি অবৈধ অর্থের পাহাড় গড়েছিল তারা নিদারুণ মানসিক সঙ্কটে পড়েছে। কিয়ামতের আগে অথবা পরে যেভাবে ধনসম্পদ মানুষের কোনো কাজে আসবে না তদ্রূপ বর্তমান সঙ্কটে পড়ে মানুষের অর্থ লোপাটকারী ব্যাংক ডাকাত, শেয়ার বাজারের ঠকবাজ, টেন্ডারবাজ প্রভৃতি নানা কিছিমের অর্থদানবেরা মনে করছে, দেশ-বিদেশে তাদের যে অর্থবিত্ত রয়েছে তা শেষ পর্যন্ত অক্ষত থাকবে তো? কুখ্যাত কারুন যেরূপ তার সোনাদানা-অর্থকড়ির মায়ার জালে আবদ্ধ হয়ে মারা পড়েছিল, তদ্রূপ বাংলাদেশের হাল আমলের কারুনেরা সম্পদের পাহাড়ের চূড়ায় বসে লোভ-লালসা ও ভোগবিলাস এবং মৃত্যুভয়কে একত্রে গুলিয়ে ফেলেছে। তারাও তাদের পাপাচারের দুর্গন্ধ নিয়ে সমাজ সংসারে মিশে যাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। ফলে দেশের ওপর এদের কালো হাতের বিষবাষ্পের মেঘ জড়ো হয়ে বিরাট এক কালবৈশাখী ঝড়ের আভাস সৃষ্টি করেছে।

চাঁদাবাজ গমচোরদের অন্যতম সহযোগী, তথাকথিত বুদ্ধির বাজারের পথবধূরা এখন আর তাদের ধান্ধাবাজির প্রচার-প্রপাগান্ডার বাদ্য বাজিয়ে স্বার্থ হাসিল করতে পারছে না। অন্যান্য সময়ে তারা তাদের গডফাদার বা মানসপিতাদের স্বার্থে যেভাবে অনবরত মিথ্যাচার করত এবং দুষ্টবুদ্ধির পসরা সাজিয়ে গমচোরদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ফেরি করে বেড়াত। তারা এখন খদ্দেরের অভাবে রীতিমতো খাদ্য সঙ্কটে পড়ে গেছে। ফলে দুর্ভিক্ষকবলিত বুদ্ধি বেশ্যার দল তাদের দুষ্টবুদ্ধিকে ইবলিসের অনুকরণে সাধারণ মানুষের মধ্যে বাজারজাত করার জন্য ফন্দিফিকির শুরু করে দিয়েছে।

এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে চাঁদাবাজ গমচোরদের জন্য একটি বিশেষায়িত নিষিদ্ধ পল্লী নির্মাণ জরুরি হয়ে পড়েছে। চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশে অপকর্ম করার জন্য অপরাধীদের অভয়াশ্রম হিসেবে বিবেচিত বিশেষ জোন রয়েছে যেখানে গমনকারীরা সাধারণত ভদ্র সমাজে চলাফেরা করতে সাহস পায় না। নিষিদ্ধ পল্লীর পতিতারা যেমন সাধারণ সমাজে চলাফেরা করার কথা চিন্তা করে না কিংবা ভদ্রজনের সামনে মুখ দেখাতে সাহস পায় না তদ্রূপ উন্নত সমাজ ও রাষ্ট্রের এমন একটা কাঠামো তৈরি করা হয় যার ফলে সাংঘাতিক চরিত্রের নষ্ট মানুষেরা ভদ্র পল্লীতে উঁকি দিতে পারে না। অন্য দিকে, যেসব শহরে নিষিদ্ধ পল্লী নেই সেসব শহরে ভ্রাম্যমাণ পতিতাদের আনাগোনা বেড়ে যায়। এছাড়া বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় ভদ্রবেশে মিনি পতিতালয় খুলে পুরো এলাকাকে বিষাক্ত করে তোলে।

নিষিদ্ধ পল্লীতে চলমান বেশ্যাবৃত্তির যে রসায়ন তার চেয়েও ভয়ঙ্কর রসায়ন ঘটে গমচোরদের নিভৃত পল্লীতে। নিষিদ্ধ পল্লীর বাসিন্দারা যদি ভদ্র সমাজের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় তবে যে ভয়াবহ দুর্গন্ধময় সমাজ সৃষ্টি হয় তার চেয়েও ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় যদি গমচোর, চাঁদাবাজরা নির্ভয়ে চলাফেরা করার অবাধ স্বাধীনতা এবং কথায় কথায় মানুষজনকে নীতিকথা শোনানোর অনৈতিক দুঃসাহস দেখাবার আশকারা পেয়ে যায়।

ঢাকা শহরে ভ্রাম্যমাণ পতিতাদের সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে পাঁচতারকা হোটেলগুলোতে পাপিয়ারূপী ওমরাও জান বা মান্ডিদের জলসা কতটা বিস্তার লাভ করেছে তা আমাদের দেশের সচেতন নাগরিকরা কমবেশি জানেন। আমাদের দেশের শহরে-বন্দরে, গ্রাম-গঞ্জে এসব পতিতা তাদের দালাল ও খরিদ্দারদের দৌরাত্ম্য যতটা না বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে তার চেয়েও মারাত্মক বিষক্রিয়া ঘটিয়েছে চাঁদাবাজ গমচোরদের সিন্ডিকেট। সুতরাং সমাজ-সংসার ও রাষ্ট্রকে বাঁচাতে হলে এই নরাধমদের জন্য আলাদা নিষিদ্ধ পল্লী নির্মাণ জরুরি হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলের কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপকে যদি ম্যাকাওয়ের মতো করে গমচোরদের অভয়ারণ্যে পরিণত করা হয় তবে বর্তমানে পুরো দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ এদের দ্বারা সংক্রমণের যে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে তা অনেকাংশে লাঘব হবে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য। 


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *